দৃষ্টিসীমায় শুধুই ট্রফি

৮ জুলাই ১৯৯৮। স্তাদো দ্য ফ্রান্সে তখন নায়কের ভূমিকায় ক্রোয়েশিয়ার ডেভর সুকার। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে তার গোলেই লিড নেয় ক্রোয়াটরা। কিন্তু নিজ দেশের হয়ে ওই দিন যে সেরা ম্যাচ খেলবেন লিলিয়াম থুরাম, তা হয়তো ফরাসিরাও জানত না। এই ডিফেন্ডারের জোড়া গোলেই ভাঙে ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত থুরাম যখন জাতীয় দল থেকে অবসর নেন, তখন তার পাশে ছিল ১৪২ ম্যাচে ২ গোল। ২০ বছর আগে দিদিয়ের দেশমের নেতৃত্বে ফ্রান্স জিতেছিল প্রথম বিশ্বকাপ। গোল্ডেন বুট জিতেও সুকারের মুখে ছিল হতাশা। বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে না পারার কষ্ট। সে কষ্টটা এবার দূর করেছেন লুকা মডরিচ-ইভান রাকিটিচরা। ৪২ লাখ জনসংখ্যার দেশটি রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিশ্বকাপের ফাইনালে দ্য ব্লেজার্সরা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে আগামীকাল শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে সেই ফ্রান্সের সামনে ক্রোয়েশিয়া। মহারণের আগে ঘুরেফিরেই আসছে ‘৯৮-এর স্মৃতি। অধিনায়ক হিসেবে দেশম যে কীর্তি গড়েছেন, এবার কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপের হাতছানি তার সামনে। কিন্তু ক্রোয়াটরা যে ইতিহাসের স্বপ্ন দেখছে, ১৯৮৮ বিশ্বকাপে হারের প্রতিশোধটাও এখন ইভান প্যারিসিচদের মনে।

১২ জুলাই ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স জিতেছিল বিশ্বকাপ। যেটা ছিল দেশটির ফুটবল ইতিহাসের সেরা মুহূর্ত। তখনও পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেননি কিলিয়ান এমবাপ্পে। ঠিক ১৬৫ দিন পর জন্ম হয়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা তারকার। গত ২০ বছর দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায়নি ফরাসিরা। ১৯ বছর বয়সী এমবাপ্পের তো এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। অনেকের মতে, ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার উঠবে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের এ ফরোয়ার্ডের হাতে। কিন্তু এমবাপ্পে ব্যালন ডি’অর চান না। তার জন্মের আগে জিনেদিন জিদান-থিয়েরি  অঁরিরা যেভাবে ট্রফি নিয়ে উৎসব করেছিলেন, এবার সেটাই করতে চান তিনি।

দুই দশক আগে ক্রোয়েশিয়ার স্পিল্ট শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিশ্বকাপের খেলা টিভিতে দেখেছিলেন নয় বছরের শিশু প্যারিসিচ। ফ্রান্সের কাছে ওই হারে অন্য সবার মতো তিনিও কেঁদেছিলেন। ২৯ বছরে এসে সেই কান্না ফিরিয়ে দেওয়ার মঞ্চ ইন্টারমিলানের এ উইঙ্গারের সামনে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রোয়াটদের জয়ের নায়কের কাছে ‘৯৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের হারটি এখন প্রেরণা। স্বপ্নের এত কাছে এসেও খালি হাতে ফিরতে চান না প্যারিসিচ।

ফাইনালে ওঠার পর তো পুরো ক্রোয়েশিয়ায় এখন চলছে উৎসব। রাশিয়ায় ফাইনাল ম্যাচ দেখার জন্য ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার কোচ জল্গাতকো দালিচ। অনেকের কাছে ফাইনাল ম্যাচটি ক্রোয়েশিয়ার কাছে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই- ট্রফি জয়ের সঙ্গে প্রতিশোধ। দালিচ যেন এই ব্যাপারটি আড়ালই করতে চাইলেন। পুরনো হিসাব চুকানোর মঞ্চটা পেলেও ক্রোয়েশিয়ান কোচ বাস্তববাদী, ‘১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথম তিন ম্যাচে আমি ফ্রান্সের সমর্থক ছিলাম। সব ক্রোয়েশিয়ানদের মনে আছে ওই ম্যাচের কথা। থুরামের জোড়া গোলে আমরা ২-১ গোলে হেরেছিলাম। এটা এমন একটা বিষয় ছিল গত ২০ বছরেও কেউ ভোলেনি। আমার মনে আছে, যখন সুকার গোল করেছিল, আমরা উৎসব শুরু করেছিলাম; কিন্তু খুব দ্রুতই আমরা দুই গোলে পিছিয়ে যাই। ফাইনালে দু’দলই তাদের সেরাটা মেলে ধরতে চাইবে। প্রতিশোধ নিয়ে ভাবছি না আমরা। এটা ফুটবল, এটা খেলা। তবে টুর্নামেন্টের ফাইনালে সেরা ম্যাচটি খেলার জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি।’

ক্রোয়েশিয়ানরা ‘৯৮ নিয়ে পড়ে থাকলেও ফরাসিরা তা নিয়ে ভাবছে না। ভাববেই বা কেন, তারা তো ক্রোয়াট বাধা পার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে। দেশমের দলের ভাবনায় এখন ফাইনালের দুঃখ মোচন। দুই বছর আগে ঘরের মাঠে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হেরেছিল ফ্রান্স। বিশ্বকাপ জিতে সেই হারের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে চান পল পগবা-অলিভার জিরুদরা। একই সঙ্গে ২০ বছর আগের স্মৃতিটাও ফিরিয়ে আনতে চান ফরাসিরা।

কাগজে-কলমে এবং অতীত ইতিহাস বিবেচনা করলে ফাইনালের ফেবারিট ফ্রান্সই। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা নেই বলে তাদের ওপর চাপ কিছুটা কম। যদি প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডও হতো, তাহলেও ভয়ে থাকত দেশমের দল। প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া বলেই হয়তো একটু নির্ভার। যদিও পল পগবা-গ্রিজম্যানরা কয়েকবারই বলেছেন, তারা ক্রোয়াটদের হালকাভাবে নিচ্ছেন না। ফ্রান্স কিছুটা নির্ভার থাকলেও দালিচের দল কিন্তু চাপেই আছে। একে ফাইনালে ওঠার, তার ওপর আছে প্রতিপক্ষ ফ্রান্সকে সামলানোর চাপ। সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর একটা ফাইনালের অপেক্ষায় ফুটবল বিশ্ব।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment